জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি

জন্ম নিয়ন্ত্রণ এর আছে নানান পদ্ধতি। যারা নতুন বিয়ে করেছেন, অনেকেই বুঝতে পারেননা কোন পদ্ধতি গ্রহন করবেন। আজকে এই পদ্ধতিগুলোর খুঁটিনাটি বিষয়ে আলোচনা করবো। আপনি দেখে নিতে পারেন কোনটি আপনার জন্য সুবিধা জনক।

জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির প্রকারভেদ:
জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি গুলোকে প্রধানত: দুইভাগে ভাগ করা যায়। যথা:
ক) সনাতন পদ্ধতি
খ) আধুনিক পদ্ধতি।

ক) সনাতন পদ্ধতিঃ
যে পদ্ধতি পরিবারের সদস্য সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ ঐতিহ্যগত ভাবে সমাজে প্রচলিত আছে সেগুলোকে সনাতন পদ্ধতি বলে। যেমন:
১) প্রত্যাহার বা আযলঃ এর মানে হচ্ছে স্বামীর বীর্য বাইরে ফেলা।
২) বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়ানো
৩) নিরাপদকাল মেনে চলা ও
৪) নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত সহবাস থেকে বিরত থাকা বা আত্মসংযম।

খ) আধুনিক পদ্ধতিঃ
আধুনিক পদ্ধতিকে আবার দুইভাগে ভাগ করা যায়। যেমন:
১) নন-ক্লিনিক্যাল এবং
২) ক্লিনিক্যাল পদ্ধতি।

১) নন-ক্লিনিক্যাল:
যে পদ্ধতিগুলো অন্যের সাহায্য ছাড়া নারী-পুরুষ নিজেই ব্যবহার করতে পারে সেগুলোকে নন-ক্লিনিক্যাল পদ্ধতি বলে। যেমনঃ খাবার বড়ি, কনডম ইত্যাদি।

২) ক্লিনিক্যাল: যে পদ্ধতিগুলো ব্যবহারের জন্য নারী-পুরষকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সেবাদানকারীর সাহায্য নিতে হয় সেগুলোকে ক্লিনিক্যাল পদ্ধতি বলে। যেমন:
ক) অস্থায়ী পদ্ধতি এবং
খ) স্থায়ী পদ্ধতি।

ক) অস্থায়ী পদ্ধতি : অস্থায়ী পদ্ধতি আবার কয়েক ধরনের রয়েছে। যেমন :
১) ইনজেকশন
২) আই.ইউ.ডি
৩)নরপ্ল্যান্ট

খ) স্থায়ী পদ্ধতি : এই পদ্ধতি দুই ধরনের। যথা :
১) পুরুষ বন্ধ্যাকরণ বা ভ্যাসেকটমী
২) নারী বন্ধ্যাকরণ বা টিউবেকটমি বা লাইগেশন৷
নিচে পদ্ধতিগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো –

* খাবার বড়ি:
জন্ম নিয়ন্ত্রনের জন্য বাজারে বিভিন্ন প্রকারের খাবার বড়ি পাওয়া যায়। যেমন: নরকোয়েস্ট, ওভাষ্ট্যাট, ওভাকন, মারভেলন, সি-৫, সুখী (স্বল্পমাত্রার বড়ি)। প্রত্যেক প্রকার বড়িতে হরমোনের মাত্রার পার্থক্য থাকতে পারে।
কার্যপদ্ধতি : ডিম্বাশয়ের ডিম্বকে পরিপক্ক হতে ও বের হতে বাধা দেয়।

সুবিধা :
১)সাফল্যের হার বেশী।
২)অনাকাংখিত গর্ভসঞ্চার খুবই কম হয়।৩)অতিরিক্ত সতর্কতা ছাড়া যৌন সহবাস করা যায়।
৪)মাসিক নিয়মিত হয়।
৫)মাসিকের রক্তস্রাব কম হয়।
৬) মাসিকের ব্যাথা থাকলে তা কমে যায়।৭) নিয়মিত বড়ি খাওয়ার ফলে অনেক মহিলার স্বাস্থ্য ভাল হয়।
৮) আয়রন বড়ির জন্য রক্তস্বল্পতা কম হয়।
৯)ডিম্বাশয় ও জরাযু ঝিল্লি¬তে ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায়।
১০) পি.আই.ডি (পেলভিসের সংক্রমণ ) কম হয়।
১১) বড়ি খাওয়া বন্ধ করলে গর্ভধারণ করা যায়।
১২) কার্যকারীতা ও সাফল্যের হার বেশী। ১৩) অনাকাংখিত গর্ভসঞ্চার খুবই কম হয়।

অসুবিধা:
১) প্রতিদিন মনে করে খেতে হয়।
২) যারা ধূমপান করে তাদের বেশী জটিলতা দেখা দেয়।
৩) টিউমার বা জন্ডিস থাকলে ব্যবহার করা যাবেনা।
৪) মাসিকের পরিবর্তন ঘটতে পারে।
৫) ওজন বেড়ে যেতে পারে।
৬) মেজাজ খিটখিটে হয়।
৭) পদ্ধতি বন্ধ করে দেওয়ার পর গর্ভধারণে দেরী হতে পারে।
৮) এইচআইভি/এইডস প্রতিরোধ করার ক্ষেত্রে কোন ভূমিকা নাই।

* কনডম :
কনডম রাবারের দ্বারা তৈরি চোঙ্গার মতো যার একদিক খোলা এবং একদিক বন্ধ বোঁটার মতো। এটি পুরুষের যৌনাঙ্গে পরতে হয়। বিভিন্ন নামে কনডম পাওয়া যায়। যেমন : রাজা, সুলতান, প্যানথার, ম্যাজিষ্টিক, সেনসেশন।

কার্যপদ্ধতি : সহবাসের সময় পুরুষাঙ্গে কনডম ব্যবহারের ফলে শুক্রকীট নারীর জরাযুতে প্রবেশ করতে পারে না । ফলে শুক্রকীট ডিম্বানুর সংস্পর্শে আসতে পারে না বলে নারী গর্ভবতী হয় না।

সুবিধা:
১) যে কোন পুরুষ ব্যবহার করতে পারে।
২) কোন ডাক্তারের সহযোগীতা লাগে না। ৩) কনডম বেশ সস্তা এবং সব জায়গায় কিনতে পাওয়াযায়।
৪) এইচআইভি/এইডস সহ নানা রকম যৌন রোগের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।
৫) যৌন সহবাস দীর্ঘায়িত হয়।
৬) জন্ম নিয়ন্ত্রনে পুরুষকে অংশগ্রহণের সুযোগ দেয়।

অসুবিধা:
১) প্রত্যেক সহবাসে ব্যবহার করতে হয়। ২) দু’জন সঙ্গীরই যথেষ্ট সহযোগিতা থাকা দরকার।

কার্যকারীতা: প্রতিবার সঠিক নিয়মে কনডম ব্যবহার করলে ৮৮% ভাগ পর্যন্ত কার্যকর হয়। এছাড়া শুক্রকীট নাশক ফেনা বড়ির সাথে ব্যবহার করলে প্রায় ৯৯% ভাগ পর্যন্ত কার্যকর হতে পারে।

ইনজেকশন :
ইনজেকশন ২ প্রকার। যথা : DMPA- সাদা রং এর দ্রবীভূত জলীয় পদার্থ, ১ ডোজ ১ টি ভায়েলে থাকে।

কার্যপদ্ধতি:
১.জরায়ুর মুখে শ্লেষ্মা তৈরী করে ফলে পুরুষের শুক্রকীট জরাযুতে ঢুকতে পারেনা।
২. ডিম্বাশয়ের ডিম্বকে পরিপক্ক হতে ও বের হতে বাধা দেয়।
৩. জরায়ুর ভিতরের গায়ে ঝিল্লীর পরিবর্তন করে, ফলে ডিম্ব জরায়ুতে বসতে পারে না।

সুবিধা:
১.নিরাপদ ও কার্যকর পদ্ধতি।
২.ব্যবহার বিধি সহজ (৩ মাসের জন্য)।
৩. রক্ত জমাট বাধার সমস্যা দেখা যায় না।
৪. সহবাসের সাথে সম্পর্ক নাই।৫.গোপনীয়তা রক্ষা করে নেয়া যায়।
৬. বন্ধ করলে গর্ভধারণ করা যায়।
৭. প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত স্বাস্থ্য কর্মী দিতে পারে।
৮. শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানো মা হলেও নেয়া যায়।

অসুবিধা:
১. অনেকের ইনজেকশন নেয়ার ক্ষেত্রে ভয় থাকে।
২. নিজে নেওয়া যায় না।

কার্যকরীতা : অত্যন্ত কার্যকরী প্রায় ১০০% ভাগ এবং নিরাপদ জন্মনিরোধক পদ্ধতি।

আই ইউ ডি বা কপার টি :
আই ইউ ডি (Intra Uterine Device) জরায়ুর ভেতরে ব্যবহারের জন্য একটি জিনিস যা জন্মনিয়ন্ত্রণ করে। অনেক উন্নত ধরণের আই ইউ ডি পদ্ধতি আবিষ্কার হয়েছে। বর্তমানে কপার-টি সবচাইতে জনপ্রিয়।

সুবিধা:
১.ব্যবহার করা সহজ।
২.প্রতিদিন মনে করতে হয় না।
৩. যৌন সঙ্গমে বাধা সৃষ্টি করে না।
৪. বুকের দুধ কমে না।
৫. যে কোন সময় খুলে ফেলা যায়।
৬. খুলে ফেলার পর গর্ভধারনের ক্ষমতা ফিরে আসে।
৭. কম খরচে বহুদিন জন্মনিরোধ করা যায়।
৮) কার্যকারীতা খুব বেশী প্রায় ৯৪-৯৮%

অসুবিধা:
১.বারবার পরীক্ষা করতে হয়।
২.অনেকে এতে অস্বস্তি বোধ করেন।

নরপ্ল্যান্ট :
বর্তমানে এক প্রকার ৬টি ক্যাপসূলে ১ ডোজ পাওয়া যায়।

কার্যপদ্ধতি : এই পদ্ধতিতে ছয়টি ছোট ছোট নরম চিকন ক্যাপসূল (দেয়াশলাই-এর কাঠির চেয়ে ছোট) মহিলাদের হাতের কনুইয়ের উপরে ভিতরের দিকে চামড়ার নিচে ঢুকিয়ে দেয়া হয়।

সুবিধা:
১.পদ্ধতিটি ৫ বছরের জন্য কার্যকর
২.পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া কম
৩.যে কোন সময় ডাক্তারের কাছে গিয়ে খোলা যায়।

অসুবিধা:
১.নিয়মিত মাসিক না হওয়া বা অনেকদিন বন্ধ থাক।
২. মাসিক বন্ধ হলে গর্ভসঞ্চার হয়েছে কিনা তা নিশ্চিত হতে হবে।
৩.মাসিকের সময় রক্তস্রাব বেশী হতে পারে।
৪.দুই মাসিকের মধ্যবর্তী সময়ে ফোঁটা ফোঁটা রক্তস্রাব হতে পারে।
৫.মাথা ব্যথা।
৬.ওজন বেড়ে যাওয়া।
৭.মন বিষন্ন থাকা।
৮.মুখে বা শরীরে মেছতার দাগ থাকলে বেড়ে যেতে পারে এবং মুখে লোম দেখা দিতে পারে।

কার্যকারীতা : এটি একটি সহজ, নিরাপদ ও কার্যকর পদ্ধতি।

ভ্যাসেকটমি:
ভ্যাসেকটমি বা পুরুষ বন্ধ্যাকরণ পুরুষদের জন্মনিয়ন্ত্রণের স্থায়ী পদ্ধতি। ছোট্ট একটি অপারেশন এর মাধ্যমে এতে শুক্রকীটবাহী নালী দুটির কিছু অংশ বেঁধে কেটে দেয়া হয়।

সুবিধা:
১.অনিচ্ছাকৃত গর্ভধারণের ভয় না থাকায় সহবাসে আনন্দ বাড়ার সম্ভাবনা থাকে।
২. তেমন কোন পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া নেই।৩.আর কোন পদ্ধতি গ্রহণের ঝামেলা থাকে না।

অসুবিধা:
যেহেতু স্থায়ী পদ্ধতি তাই পরবর্তীতে সন্তান চাইলেও তা প্রায় অসম্ভব।

কার্যকরীতা: স্থায়ী জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি এবং প্রায় ১০০%ভাগ কার্যকরী।

টিউবেকটমি/লাইগেশন : খুব ছোট অপারেশনের মাধ্যমে মহিলার প্রজনন ক্ষমতাকে স্থায়ীভাবে বন্ধ করাই হচ্ছে লাইগেশন । জরায়ুর দুই ধারে দুটি ডিম্ববাহী নালী থাকে। সেই নালী দুটির কিছুটা অংশ বেঁধে কেটে দেয়াকে লাইগেশন বলে।
কার্যপদ্ধতি : ডিম্বাশয় থেকে ডিম্ব বের হয়ে শুক্রানুর সাথে মিলিত হতে পারে না, ফলে গর্ভ সঞ্চার হয়না।

সুবিধা:
অনিচ্ছাকৃত গর্ভধারণের ভয় না থাকায় সহবাসে আনন্দ বাড়ার সম্ভাবনা থাকে। তেমন কোন পাশ্ব-প্রতিক্রিয়া নেই। আর কোন পদ্ধতি গ্রহণের ঝামেলা থাকে না। গর্ভবতী হলে মৃত্যুঝুঁকি আছে এমন নারীর জন্য খুবই প্রযোজ্য। আর সন্তান না চাইলে এই অপারেশন খুবই ভাল।

অসুবিধা:
১) যেহেতু স্থায়ী পদ্ধতি তাই পরবর্তীতে সন্তান ধারণ করতে চাইলেও তা সম্ভব নয়।
২) অপারেশনের পর একরাত হাসপাতাল অথবা ক্লিনিকে থাকতে হয়।

কার্যকরীতা : স্থায়ী জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি। প্রায় ১০০%ভাগ কার্যকরী।

পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি সেবা প্রাপ্তির জন্য যোগাযোগ
* পরিবার পরিকল্পনা কর্মী
* স্বাস্থ্য কর্মী
* স্যাটেলাইট ক্লিনিক
* ইউনিয়ন পর্যায়ে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র
* মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্র
* উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স
* জেলা হাসপাতাল
* বেসরকারী ক্লিনিক

Loading

Admin

By Admin

ডাঃ মোঃ আব্দুল কুদ্দুস, পল্লী চিকিৎসক

Leave a Reply